আর দশটি ভালোবাসার কাহিনীর মতো মোটেই নয় তন্বী এবং তামিমের গল্পটা। উত্থান-পতন, ভীষণ ভয়ংকর সব ঘটনা এবং সবশেষে ভালোবাসার মাঝে জীবনের প্রস্ফুটন- তাদের এই ভালোবাসা নিয়ে লেখা যাবে গল্প, মহাকাব্য। জীবনের মাঝেই যে জীবনের চাইতেও বড় ভালোবাসা লুকিয়ে থাকতে পারে, তারই উদাহরণ তরুণ এই দম্পতি। আসুন জেনে নেই সেই গল্প।
একই কলেজে পড়াশোনা থেকে ঘটনার সূত্রপাত। তন্বীকে সবাই চিনতো সেই মেয়ে হিসেবে, যে কখনো কোনো ছেলের সাথে কথা বলে না। হাঁটার সময়েও চোখ নিচের দিকে, যেন ভুলেও কারো চোখে চোখ না পড়ে। সেই মেয়েরই প্রেমে ভীষণ হাবুডুবু খেয়ে যায় তামিম। একই প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ার সময়ে সেই প্রাইভেট টিউটরের থেকে তন্বীর ফোন নম্বর চুরি করে বসে তামিম, এরপর ফোনে ফোনে কথা, বন্ধুত্ব কখন গড়িয়েছে প্রেমে।
কলেজ জীবনের এই প্রেম কখনো পরিবার অথবা বন্ধুদের জানতে দেয়নি তন্বী। একই কোচিং সেন্টারে মডেল টেস্ট দেবার সময়ে দুজনে পাশাপাশি বসা অথচ ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পায়না তারা প্রেমিক-প্রেমিকা।চলতে থাকে এই লুকোচুরি প্রেম।
কলেজ জীবন শেষ হতেই হঠাৎ দুজনের মাঝে দুরত্ব। কেন? কারণ দুজন দুই মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়। তন্বী ভর্তি হয় ঢাকার আদ-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজে। আর তামিম সেই সুদুর সিরাজগঞ্জে। এতো দুরত্ব সহ্য করেও চলেছে তুমুল প্রেম। মাঝে মাঝেই ঢাকায় এসে তন্বীর সাথে দেখা করে যেত তামিম।
এরই মাঝে একদিন ঘটে যায় বিপর্যয়। কলেজে যাবার পথে এক জায়গায় বাস চেঞ্জ করতে হয় তন্বীকে। বাস চেঞ্জ করে সবসময় তামিমকে ফোন দিতে হয়। কিন্তু জানুয়ারির সেই দিনে বাস চেঞ্জ করতে গিয়ে মোটোরবাইকের সাথে এক্সিডেন্ট হয় তন্বীর। মাথায় ভীষণ আঘাত পেয়ে নাক দিয়ে হতে থাকে রক্তপাত। হাসপাতালে নেবার পর রক্তবমি হয়, জ্ঞান হারায় তন্বী। তামিমকে আর ফোন করা হয় না তার।
ফোন না পেয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে তামিম। এরপর তন্বীর বন্ধুরা যখন তাকে ফোন করে জানায় কী ঘটেছে, তখন আর কিছুতেই স্থির থাকতে পারে না সে। যত দ্রুত সম্ভব ঢাকায় প্রেমিকার কাছে চলে আসে। এরপর দিনরাত ছায়ার মতো রয়ে যায় তন্বীর পাশেই।
তন্বীর এক্সিডেন্টটা ছিলো খুবই ভয়াবহ। মস্তিষ্কে অপারেশনের পর কিছুদিন সে স্মৃতি হারিয়ে ফেলে। কিছুটা চিনতে পারে বাবা-মাকে, প্রেমিককে। কিন্তু তাদের ব্যাপারে আর কিছু মনে করতে পারে না। একেবারেই শিশুসুলভ হয়ে যায় তার চিন্তা।
এই দুর্যোগের সময়ে প্রতিটি ক্ষণ তার পাশে রয়ে যায় তামিম। একটু একটু করে তার যত্ন নেওয়া, কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে তার স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে নিজেকে ঢেলে দেয় তামিম। ওদিকে মেডিক্যালের ক্লাসে রয়ে যায় অনুপস্থিত। এ সময়েই প্রথম তামিমের ব্যাপারে জানতে পারে তন্বীর বাবা-মা। যে ছেলেটি নিজেকে উজাড় করে দিয়ে তন্বীর কাছে আছে, সে তন্বীর অনেকদিনের পুরনো প্রেমিক তা এই প্রথম জানতে পারেন।
তন্বীর সেরে উঠতে সময় লেগে যায় বেশ কিছুদিন। এর মাঝেই তামিম আবিষ্কার করে, এই মানুষটিকে ছাড়া সে বেঁচে থাকতে পারবে না কিছুতেই। একবার যাকে প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলো, তাকে আর হারাতে চায় না তামিম। তাই তন্বীর বাসায় এবার পাঠানো হয় বিয়ের প্রস্তাব।
এতো সহজে বিয়েটা মেনে নেবেন না কোনো পক্ষই। দুই পক্ষেরই একই যুক্তি, দুজনেই এখনো পড়াশোনা করছে, এখন নয় বরং পড়ে দেওয়া যাবে বিয়ে। কিন্তু দুর্ঘটনার পর তন্বী এবং তামিম একটুও দেরি করতে নারাজ। তাদের কারনেই বাধ্য হয়ে ঘরোয়াভাবে বিয়ের আয়োজন করা হয়।
বিয়েটা হয় দুজনেরই সেকেন্ড প্রফেশনাল এক্সামের মাত্র ১৫ দিন আগে। এতো ঝড় ঝাপ্টার পরেও দারুণ ভালো ফলাফল করে তামিম।
এরপর চলতে থাকে দুজনের ভালোবাসা। দুজনের পড়াশোনা দুই জায়গাতেই বলে দুরত্ব রয়েই যায়। এই বছরের শুরুর দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে উঠিয়ে নেওয়া হয় তন্বীকে। কিন্তু দুজনের সংসার এখনো পাতা হয়নি। একজন সিরাজগঞ্জে, আরেকজন ঢাকায়। আগে তন্বীর সাথে দেখা করতে তামিম আসতো ঢাকায়, এখন তন্বীও তামিমের টানে মাঝেমাঝে চলে যায় সিরাজগঞ্জ।
মস্তিষ্কে অপারেশনের পর অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। কোনো কিছুরই গন্ধ পায় না তন্বী। তামিম ভালোবেসে এক তোড়া ফুল এনে দিলে তন্বী তার সুবাস পায় না ঠিকই। কিন্তু এতে কারো কিছু যায় আসে না। ফুল যে এনেছে তার ভালোবাসাটা যে খাঁটি, তা নিশ্চিত জানে তন্বী!