মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

নামেই শুধু ছাত্রী হোস্টেল, কাজে…

1লাকমিনা জেসমিন সোমাঃ শরতের স্বচ্ছ আকাশ। চারদিকে ঝলমলে রোদ। শহর কিংবা গ্রামের বাড়িগুলোতে তখন ঘরভর্তি আলো। এমন দিনে রাজধানীর খামারবাড়ির মনিপুরিপাড়া এলাকার একটি ছাত্রী হোস্টেলে গিয়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। ছাত্রীনিবাসটির চতুর্থ তলার একটি কক্ষে ঢুকতেই হঠাৎ যেন রাত নেমে এলো। জানালাবিহীন হার্ডবোর্ডে মোড়া ওই কক্ষের দুই শিক্ষার্থী জানালেন, বিদ্যুৎ না থাকলে তাদের কাছে রাত-দিন সবই সমান। কখন সকাল হচ্ছে আর কখন বিকাল, কিছুই বুঝতে পারেন না। এমনকি রুমের সামনের গলি পার হয়ে বারান্দায় না গেলে ঝড়-বৃষ্টিও অাঁচ করতে পারেন না তারা।
এটি মনিপুরিপাড়ার ২ নম্বর গেট সংলগ্ন ‘মাই হোম ছাত্রী হোস্টেল’ নামের এই ছাত্রীনিবাসের চিত্র। এই হোস্টেল ঘুরে এমন আরও অনেক অভিযোগ পাওয়া গেল। শুধু এই হোস্টেলই নয়, রাজধানীতে গড়ে ওঠা ছাত্রী হোস্টেলগুলোর এমনই অবস্থা। প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছেন মেস মালিক বা হোস্টেল ব্যবসায়ীরা।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্যমতে, রাজধানীতে প্রায় দেড় লাখ ছাত্রী রয়েছেন, যারা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। এই ছাত্রীদের বেশির ভাগই ঢাকার বাইরে থেকে আসা। অন্যদিকে কর্মজীবী নারীদের জন্য রাজধানীতে সরকারি হোস্টেল আছে মাত্র তিনটি। এগুলোতে সবমিলিয়ে ৮৩০টি আসন। আর সে কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাতেগোনা কয়েকটি হল ও সরকারি হোস্টেল ছাড়া বাকিরা আশ্রয় নেন ব্যক্তিমালিকানাধীন এই হোস্টেলগুলোতে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হোস্টেল মালিকরা সবচেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এইচএসসি পরীক্ষার পর। এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আশায় মফস্বল থেকে হাজার হাজার ছাত্রী ঢাকা আসেন কোচিং করতে। রাজধানীর ফার্মগেট, মনিপুরিপাড়া, রাজাবাজার, গ্রীনরোড, আজিমপুর, মগবাজার, বকশীবাজার, নীলক্ষেত, মোহাম্মদপুর, আসাদগেট, ধানমন্ডি, জিগাতলা, লালমাটিয়াসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছাত্রী হোস্টেলগুলোতে ভিড় জমান ছাত্রীরা। এই সুযোগে তাদের জিম্মি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেন হোস্টেল ব্যবসায়ীরা।
হোস্টেলগুলোর কমন সমস্যার মধ্যে রয়েছে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায়, নিম্নমানের খাবার, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং নিরাপত্তাহীনতা। রাজধানীর বেশ কয়েকটি ‘ভিআইপি’ ছাত্রী হোস্টেল ঘুরে দেখা গেছে শিক্ষার্থীরা হাজার হাজার টাকা সিটভাড়া দিয়েও বস্তিবাসীর মতো জীবন-যাপন করছেন। অফিস বা ফ্যামিলি বাসা ভাড়া নিয়ে হোস্টেল পরিচালনা করছেন ব্যবসায়ীরা। বাড়িগুলোকে বাণিজ্যিক হোস্টেল হিসেবে চালানোর জন্য একেকটি রুমকে পাতলা হার্ডবোর্ডের পার্টিশন দিয়ে কখনো দুই ভাগে আবার কখনো চার ভাগে ভাগ করা হচ্ছে। ফলে হোস্টেলগুলোতে সিঙ্গেল এবং ভিআইপি রুম হিসেবে কখনো কিচেনে আবার কখনো বারান্দায় ঠাঁই হচ্ছে ছাত্রীদের। এরপর কবুতরের খোঁপের মতো ওই হার্ডবোর্ডে মোড়া রুমগুলোকে সিঙ্গেল রুম হিসেবে চালিয়ে পাঁচ থেকে আট-দশ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। রুমগুলোতে সর্বোচ্চ দুই হাত চওড়া খাট ছাড়া চেয়ার-টেবিল রাখার জায়গা থাকে না। কোনোরকম একটি করে টেবিল দেওয়া হলেও সেগুলো এতই ছোট যে তা কোনো কাজেই আসে না। খাওয়া-দাওয়া, পড়াশোনা, আড্ডা কিংবা ঘুম, সবই করতে হয় ওই ছোট্ট বেডের ওপরেই। মাইহোম হোস্টেলের আইইউবিতে পড়ুয়া এক ছাত্রী বলেন, হার্ডবোর্ডে ঘেরা এই রুমগুলোতে সিঙ্গেল থাকা না থাকা সমান কথা। পাশের রুমের কারও মোবাইলে সামান্য ভাইব্রেশন হলেও তা অন্যরুম থেকে শোনা যায়। একই এলাকার ‘উইমেন্স স্টাডি হোম’ হোস্টেলের এক ছাত্রী বলেন, তাদের হোস্টেলে প্রায় ১৫ জনের জন্য বাথরুম আছে মাত্র একটি। রাজধানীতে বহুল পরিচিত নিবেদিকা ছাত্রী হোস্টেলই রয়েছে কমপক্ষে ৭০টি। এর বাইরে মেস মালিকদের সংগঠন হোস্টেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হোয়াব) তথ্যমতে, রাজধানীতে তাদের অন্তর্ভুক্ত প্রায় ৫৭টি হোস্টেল রয়েছে। এগুলোর শাখা-প্রশাখা মিলিয়ে ছাত্রী হোস্টেলের সংখ্যা দুই শতাধিক।
ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত এই হোস্টেলগুলোর মধ্যে এমন ভবনও আছে যেখানে গ্যাস সংযোগ নেই। অন্যদিকে লিফট্ ভাড়া, জেনারেটর ভাড়া আদায় করলেও সেগুলো কখনোই চালু রাখা হয় না। বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা। নিবেদিকা হোস্টেলের লালমাটিয়া শাখার মেডিকেল ভর্তিচ্ছু এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের হোস্টেলে জনপ্রতি ল্যাপটপের জন্য অতিরিক্ত ১০০ টাকা, ফ্রিজের জন্য ৫০০ টাকা, রাইসকুকার এবং ওয়াটার হিটারের জন্য ৩০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।
নিবেদিকা হোস্টেলের একটি শাখার পরিচালক বলেন, ছাত্রীদের কাছ থেকে টাকা না নিয়েও উপায় থাকে না। তাদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে পাড়া-মহল্লার মাস্তান কিংবা নেতাদের বহু টাকা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে এভাবে হোস্টেল ব্যবসা করা যেত না।
হোস্টেলগুলোতে খাবার পরিবেশন হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। কঠোর নিয়ম-নীতি ও নিরাপত্তার কথা বললেও প্রায়ই ঘটে চুরির ঘটনা। কখনো হোস্টেলের ভিতরের আবার কখনো বহিরাগত চোরের খপ্পরে টাকা-পয়সা, মোবাইল, ইলেকট্রনিক সামগ্রীসহ মূল্যবান জিনিসপত্র হারান ছাত্রীরা।
নিবেদিকা ছাত্রী হোস্টেলের বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে মনিপুরি শাখার হোস্টেল সুপার সুমির সঙ্গে যোগাযোগ করলে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি। বলেন, ‘তাই না কি? জানতাম না তো!’ অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করে বরং আরও ভালোভাবে হোস্টেল ঘুরে দেখার পরামর্শ দেন তিনি।
Share:

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ব্লগ সংরক্ষাণাগার

Recent Posts

Unordered List

Definition List