শনিবার, ২৬ মার্চ, ২০১৬

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে আস্থা নেই সিআইডি’র

শেখ আবু তালেব, ঢাকা : বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লুটের ঘটনায় ধীরে চলো কৌশলে এগোচ্ছে তদন্ত সংস্থা সিআইডি। ঘটনার মূল রহস্য উদ্ঘাটনে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্যের উপর আস্থা রাখছে না তারা। সিআইডি’র জিজ্ঞাসাবাদে ব্যাংক কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য সঠিক কি-না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সংগ্রহকৃত আলামতের ফরেনসিক পরীক্ষার পাশাপাশি তথ্যের সঠিকতা যাচাই ও বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্য লুকোচ্ছে কি না তা বের করতে নেওয়া হচ্ছে কূটনৈতিক মিশনগুলোর সাহযোগিতা। এজন্য কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করেই চালানো হচ্ছে তদন্তের কাজ। সব তথ্য একত্রিত করতে একটু সময় লাগতে পারে বলেই কৌশল এগোচ্ছে সংস্থাটি। কূটনৈতিক ও সিআইডিসহ তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সংস্থার সূত্র এতথ্য নিশ্চিত করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চুরি করেছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করছে, এর মধ্যে ১৯ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার শ্রীলংকা থেকে ফেরত আনা গেছে। আর ৮১ মিলিয়ন ডলার রয়েছে ফিলিপাইনে। সেখান থেকে মাত্র ৬৮ হাজার ডলার বাংলাদেশ ফেরত পেয়েছে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় মাত্র ৫৪ লাখ টাকা। কিন্তু ফিলিপাইনের পত্রিকা বলছে, দ্বিতীয় দফায় আরো ৮৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৬ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা চুরি করে পাঠানো হয় ফিলিপাইনে।  ফেডারেল রিজার্ভের সন্দেহ হলে সেই অর্থের ছাড় আটকে দেয় ফিলিপাইন। পরে সে অর্থ ফেরত নেয় ফেডারেল রিজার্ভ। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই বলেনি। এটিও চেপে রেখেছে।

অর্থ চুরির বিষয়টি তদন্ত করছে দেশের ৫টি সংস্থা। তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে ইতিমধ্যে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এবারের তদন্তটি সিআইডির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, চুরির ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে প্রযুক্তির মাধ্যমে। দু’ভাবে চলছে তদন্ত কাজ। একটি হচ্ছে প্রযুক্তিগত ও অন্যটি হচ্ছে এ কাজে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, আমরা ইতিমধ্যে অনেক দূর এগিয়েছি। আশা করছি চক্রের হোতারা খুব দ্রুত চিহ্নিত হবে।

তদন্ত সংস্থা সিআইডির এক সূত্র বলছে, প্রযুক্তিগত বিষয়ে অনেকটা অগ্রসর হওয়া গেছে। কিছু তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে। একটু সময় লাগলেও সিআইডির আইটি এক্সপার্টরা অনেক তথ্য উদ্ধার করতে সক্ষম হবে বলে আমাদের বিশ্বাস রয়েছে।

ব্যাংকের সাড়ে ৪ হাজার কম্পিউটারের মধ্যে ৫০টিকে গুরুত্ব দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় ব্যাংক কর্মকর্তারা কতটুকু জড়িত বা তাদের ব্যবহার করা হয়েছে কি না তা নিয়ে তদন্ত চলছে। ঘটনাটিতে আন্তর্জাতিক জালিয়াত চক্র জড়িত থাকায় একটু সতর্ক হয়ে এগুচ্ছে সিআইডি।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কিছু কর্মকর্তাকে সিআইডি কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সংস্থাটি। প্রাপ্ত আলামত ও কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য যাচাই বাছাই করছে তারা। এতদিন বিক্ষিপ্তভাবে তদন্ত কাজ চালালেও এখন ছক আঁকতে পেরেছে তারা। সেই ছকের আলোকেই এগিয়ে চলছে তদন্ত কাজ। ঘটনার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে চিহ্নিতও করতে পেরেছে সিআইডি। এমন তথ্যই নিশ্চিত করেছে সূত্রটি।

চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি একটি প্রশিক্ষিত সংঘবদ্ধ চক্রের কাজ এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত সংস্থাগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া ও জিজ্ঞাসাবাদে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য পরিকল্পিতভাবেই সিআইডিকে দেওয়া হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাচ্ছে সংস্থাটি। এজন্য তথ্যর সঠিকতা যাচাই ও আরো তথ্য সংগ্রহের জন্য কাজে লাগানো হচ্ছে কূটনৈতিক মিশনগুলোকে। কয়েকটি দেশের কূটনৈতিক মিশনে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। তথ্য যাচাই, দেওয়া তথ্যে গড়মিল ধরতে ও নতুন তথ্য পাওয়া যায় কি না সে বিষয়ে মিশনগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে। এ তথ্যগুলো নিশ্চিত করেছে কূটনৈতিক সূত্রগুলো।

মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেছে তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা। সিআইডির ডিআইজি সাইফুল আলমের নেতৃত্বে একটি দল গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে তদন্ত কাজ নিয়ে আলোচনা করেন। গত ২৪ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভংকর সাহা বলেছেন, তদন্তের অগ্রগতি আছে। তদন্তের স্বার্থে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছি না। তবে অগ্রগতি আছে এবং যথেষ্ট অগ্রগতি আছে।

এদিকে রিজার্ভে থাকা টাকা চুরির অর্থ উদ্ধারে আইনি পদক্ষেপ জানতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চিঠিতে চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধারে আইনি পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কি ধরণের কাগজপত্র তৈরি করতে হবে সে বিষয়ে জানাতে বলা হয়েছে। ফিলিপাইন, শ্রীলংকা ও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সকল ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে আইনজীবী আজমালুল হক কিউসিকে নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর- ৩ এস কে সুর চৌধুরী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মামলা করতে হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সহায়তা লাগবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দুদককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

মামলার কার্যক্রমে ধীরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অর্থনীতি বিশ্লেষক ও বোদ্ধা মহল। তারা বলছেন, অতীতে ঘটে যাওয়া ব্যাংকিং কেলঙ্কোরির মত এ ঘটানটিকেও ধামাচাপা দিয়ে হিমাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে কি-না তাও ভেবে দেখতে হবে। এ ঘটনায় দু’টি পক্ষ রয়েছে। একটি দেশে, আরেকটি বিদেশে। দেশের সংশ্লিষ্ট লোকজনদের বের করতে কালক্ষেপণ করা মোটেই উচিত হবে না বলেও মন্তব্য করছেন বিশ্লেষকরা।
Share:

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ব্লগ সংরক্ষাণাগার

Recent Posts

Unordered List

Definition List