আতঙ্কে দিশেহারা। বিস্ফোরণে জখম দুই মহিলা। মঙ্গলবার ব্রাসেলসের বিমানবন্দরে।ছবি: রয়টার্স।
আজ সকালে বিমানবন্দর থেকে মেট্রো রেল— পরপর তিনটি আত্মঘাতী বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস। সরকারি সূত্রে খবর, নিহত অন্তত ৩৪। শতাধিক আহতের মধ্যে রয়েছেন জেট এয়ারওয়েজের দুই ভারতীয় কর্মীও।
হামলার দায় নিয়েছে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। তাদের বিরুদ্ধে নামা আন্তর্জাতিক সামরিক জোটে রয়েছে বেলজিয়ামও। সেই খোঁচা দিয়েই আইএস বলেছে, ‘‘আমাদের বোমা মেরে ওড়াতে চেয়েছিল বেলজিয়াম। এ বার ওরাই দেখুক কেমন লাগে!’’
এই ঘটনার পরেই নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা পড়েছে জার্মানি থেকে নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স থেকে ব্রিটেন। সতর্ক আমেরিকাও। কিন্তু ঢাকা পড়ছে না আতঙ্ক। সেই সঙ্গে একটা অসহায়তা। ২০১৫-র নভেম্বরে প্যারিসে আইএসের হামলায় প্রাণ গিয়েছিল ১৩০ জনের। সেই হামলার অন্যতম পাণ্ডা সালাহ আবদেসলামকে মাত্র তিন দিন আগে পিৎজা ডেলিভারির নাম করে পায়ে গুলি করে ধরেছিল বেলজিয়ান পুলিশ। জেরায় আবদেসলাম নাকি বলেছিল, প্যারিসের কায়দায়তেই এ বার বেলজিয়ামে ‘বড় কিছু’ ঘটাতে চাইছে আইএস।
তার পরেও রোখা গেল না রক্তস্রোত। এবং আবদেসলামের গ্রেফতারির প্রতিশোধ নিতেই এই হামলা কি না, সেটাও ভাবাচ্ছে গোয়েন্দাদের। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আজ বলেছেন, ‘‘বিশ্বকে এক হতেই হবে। বিশ্বাস, ধর্ম, চামড়ার রং আর ভৌগোলিক অবস্থানের ঊর্ধ্বে উঠে সন্ত্রাসবাদকে হারাতে হবে।’’ কিন্তু অনেকেই মানছেন, আল কায়দাকে নিয়েও হয়তো এতটা অসহায় দশা হয়নি গোটা বিশ্বের। উপরন্তু আজ আইএস বলেছে, ব্রাসেলসের চেয়েও বড় হামলা হবে ব্রিটেনে। সেই হুমকি উপেক্ষা করতে পারেননি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। ব্রাসেলসের অনেক আগেই পাতাল রেলে (টিউব) হামলা দেখেছে তার দেশ। কাজেই ঝুঁকি না নিয়ে আজই মন্ত্রিসভার বিশেষ কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি।
আজ স্থানীয় সময় সকাল ৮টা নাগাদ প্রথম বিস্ফোরণটি হয় ব্রাসেলস বিমানবন্দর থেকে বেরোনোর রাস্তায়। এর কয়েক সেকেন্ড পরেই আমেরিকান এয়ারলাইন্সের চেক ইন কাউন্টারের কাছে দ্বিতীয় বিস্ফোরণ। এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ তিনি শুনতে পান আরবি ভাষায় চিৎকার। তার পরেই বিস্ফোরণ। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ১৪ জনের। গুঁড়িয়ে যাওয়া কাচ আর দেওয়াল থেকে খসে পড়তে থাকা চাঙড়ের স্তূপ তখন রক্তে মাখামাখি। তার মধ্যেই প্রাণভয়ে ছুটতে থাকেন যাত্রীরা। বছর তিরিশের যুবক ড্রাইস ভালাএর্ত পরে বলছিলেন, ‘‘অনেকে ভাবছিল পটকা ফাটছে। গুলিও চলছিল বোধহয়। ছুটতে ছুটতে দেখি, এক মহিলার হাতে গর্ত হয়ে রক্ত ঝরছে অঝোরে।’’
ব্রাসেলস বিমানবন্দরে (যাকে জাভেন্তেম বিমানবন্দরও বলা হয়) হামলার ঘণ্টা দেড়েকের মাথায়, সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ বিস্ফোরণ হয় মালবিক মেট্রো স্টেশনে। যার ৪০০ মিটারের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দফতর। পুলিশ জানাচ্ছে, মালবিকের পাতাল-স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে তখন বেরোচ্ছিল একটি মেট্রো। তারই শেষ কামরাটি উড়ে যায় বিস্ফোরণে। তক্ষুনি ট্রেন থামিয়ে সুড়ঙ্গের মধ্যেই নামিয়ে আনা হয় যাত্রীদের। সুড়ঙ্গ দিয়ে হেঁটে পরের স্টেশনে পৌঁছন তাঁরা। তত ক্ষণে পরের পর দেহ উদ্ধার হচ্ছে মালবিক স্টেশনে। রাত পর্যন্ত সংখ্যাটা ২০।
‘‘এই হামলা নৃশংস এবং কাপুরুষোচিত’’— বলেছেন বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী চার্লস মিশেল। হামলার পরেই সিল করে দেওয়া হয়েছে ফ্রান্স-বেলজিয়াম সীমান্ত। বন্ধ ব্রিটেন-বেলজিয়াম ‘ইউরোস্টার’ ট্রেন। আগামিকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত স্তব্ধ জাভেন্তেম বিমানবন্দরও। একই ছবি ইউরোপের প্রায় সমস্ত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
বেলজিয়ান পুলিশ-সূত্রে খবর, বিমানবন্দরে একটি না-ফাটা বিস্ফোরকের বেল্ট এবং একটি কালাশনিকভ রাইফেল মিলেছে। দু’টিতেই আইএসের ছাপ স্পষ্ট। তা ছাড়া, বিমানবন্দরের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তিন যুবককে চিহ্নিত করা হয়েছে। ট্রলি বোঝাই মালপত্র নিয়ে লাউঞ্জে ঢুকেছিল তারা। পুলিশের সন্দেহ, এদের মধ্যে দু’জন আত্মঘাতী জঙ্গি। খোঁজ চলছে তৃতীয় জনের। কয়েক জন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। শহরতলির স্কারবেক এলাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্টে তল্লাশি চালিয়ে আইএসের পতাকা এবং একটি বোমা উদ্ধার হয়েছে বলে সরকারি
কৌঁসুলি জানিয়েছেন।
নিহতদের তালিকায় কোনও ভারতীয়র নাম এখনও নেই। জেট এয়ারওয়েজ জানিয়েছে, ব্রাসেলসের হাসপাতালেই চিকিৎসা চলছে তাদের আহত দুই কর্মীর। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ বলেছেন, ‘‘ফের স্পষ্ট হয়ে গেল, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সকলের একজোট হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।’’
আতঙ্কের সকালের পর রাতে বেলজিয়ামের জাতীয় পতাকার রঙের আলোয় আইফেল টাওয়ার সাজিয়ে নিহতদের শ্রদ্ধা জানিয়েছে ফ্রান্স। প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ বলেছেন, ‘‘গোটা ইউরোপকে নাড়িয়ে দিয়েছে এই ঘটনা।’’ source anandabazar
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন